কিভাবে আপনার শরীরের চর্বি কমাবেন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দেখে নিন

 যকৃতে চর্বি জমা রোধে কী করবেন


ফ্যাটি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমা শুধু একটি রোগ নয়, এটি জটিল বহুমুখী সমস্যাও। যা পরবর্তী সময়ে বড় অঘটন ঘটাতে পারে। তবে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে রোগটি নিরাময়যোগ্য।


ফ্যাটি লিভার বা যকৃতে চর্বি জমার কথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায়। অনেকেই বলেন, আমার তো লিভারে চর্বি জমেছে।


সেই প্রচলিত কথাটাই সত্য—বেশি ভালো, ভালো নয়! লিভারে ৫ শতাংশ পর্যন্ত চর্বি থাকাটা স্বাভাবিক কিন্তু এর বেশি ভালো নয়। লিভারে চর্বির বাড়াবাড়িকেই বলে ফ্যাটি লিভার। হাল জমানায় ফ্যাটি লিভারের ‘বাড়াবাড়ি’ বেড়ে গেছে। কেউ কেউ এই রোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলেও এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা একে ধর্তব্যে নিতে চান না। তাঁদের ভাবখানা এমন যে আলট্রাসনোগ্রাম করলেই লিভারে একটু–আধটু চর্বি পাওয়া যায়, এ আর এমন কী!


কিন্তু একেও নিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। কারণ, লিভারে যাঁদের চর্বি থাকে, তাঁদের কারও কারও লিভারে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দেখা দেয়। একে বলা হয় নন–অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস, সংক্ষেপে ন্যাশ। আর যাঁদের ন্যাশ হয়, তাঁদের সবার ভাগ্য ভালো না–ও হতে পারে। তাঁদের মধ্যে কারও কারও লিভার পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়; যাকে বলে লিভার সিরোসিস। কারও কারও পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে। মানে তাঁদের লিভারে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।


যকৃতে কেন চর্বি জমে


যাঁদের মেদ-ভুঁড়ি আছে, তাঁদের লিভারে চর্বি জমবে, সে তো বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া এমন কিছু রোগ আছে, যেসব রোগে লিভারে জমতে পারে বাড়তি চর্বি। যেমন ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে চর্বির আধিক্য, হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপারটেনশন, ক্রনিক হেপাটাইটিস সি, পলিসিস্টিক ওভারি ইত্যাদি যাঁদের আছে। এ ছাড়া লিভারে চর্বি জমে অতিরিক্ত মদ্যপানে। কাজেই যখন কোনো ব্যক্তি লিভারে চর্বি বা ফ্যাটি লিভার নিয়ে আমার মতো কোনো লিভারের চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হন, তখন আমাদের একটা বড় দায়িত্ব হচ্ছে দেখে নেওয়া যে রোগীর এসব রোগের কোনোটি আছে কি না। থাকলে তার চিকিৎসা করাটাও জরুরি।


আর চর্বি যে শুধু লিভারে জমে, এমনটা নয়। জমতে পারে হৃৎপিণ্ড বা মস্তিষ্কেও। কাজেই লিভারের পাশাপাশি এসব জায়গারও দু-একটা পরীক্ষা করে দেখে নেওয়াটা ভালো।


ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি মেলে কীভাবে


ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে সুচিকিৎসা হচ্ছে জীবনযাত্রার পরিবর্তন। রাতে মুঠোফোন টিপে বা টক শো দেখে দেরি করে খেয়ে সোজা বিছানায় যাওয়া নয়; বরং আগেভাগে খেয়ে নিয়ে তারপর অন্য কাজ সেরে নিন। খাওয়ার অন্তত দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর ঘুমাতে যাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। এ ছাড়া বাড়তি বা অপ্রয়োজনীয় শর্করা, যেমন চায়ে চিনি, মিষ্টি, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি বাদ দেওয়া। আর গরু-খাসি, ফাস্ট ফুড-ফ্যাটি ফুড যে বর্জনীয়, সেটা তো বলাই বাহুল্য। সঙ্গে সপ্তাহে পাঁচ দিন আধঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করুন। মনে রাখতে হবে, কেউ যদি শরীরের ওজন ১০ শতাংশ কমাতে পারেন, তবে তাঁর লিভারে চর্বি কমে যায় প্রায় অর্ধেক। দেখা যায়, যেসব ফ্যাটি লিভার রোগী অসচেতন, তাঁরা আর দশজন লিভার রোগীর চেয়ে আগে মৃত্যুবরণ করেন। কারণ, চর্বি যে শুধু লিভারে জমে, তা নয়। চর্বি জমে হৃৎপিণ্ড আর মস্তিষ্কেও। ঝুঁকি বাড়ে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের। বাড়তি চর্বি বাড়ায় ক্যানসারের ঝুঁকিও। অন্যদিকে লিভারে ফ্যাট আছে জেনে যাঁরা সতর্ক হয়ে যান, তাঁরা সাধারণত দীর্ঘ, সুস্থ জীবনের অধিকারী হন। কারণ, জীবনাচরণ পাল্টে লিভারে চর্বি কমার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে যায়।


ফ্যাটি লিভারের কি কোনো ওষুধ আছে


উত্তরটা একই সঙ্গে হ্যাঁ এবং না। অর্থাৎ এখনো এমন কোনো ওষুধ নেই, যা শুধু ফ্যাটি লিভার সারাই করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো লিভারে চর্বি কমায় আর লিভারকে ভালো রাখে। এ তালিকায় যেমন আছে ভিটামিন ই অথবা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, তেমনি আছে হালের সিমাগ্লুটাইড আর ওবিটাকলিক অ্যাসিড। এই ওষুধগুলো অন্য রোগের ওষুধ হলেও এগুলো ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমাণিত।


শেষ কথা


ফ্যাটি লিভার কেবল একটি রোগ নয়, এটি একটি জটিল বহুমুখী সমস্যা, যা পরবর্তী সময়ে বড় অঘটন ঘটাতে পারে। তবে সময়মতো ধরা পড়লে আর সঠিক ব্যবস্থা নিলে ফ্যাটি লিভার যে নিরাময়যোগ্য, তা–ও কিন্তু ঠিক। কাজেই কোনো কারণে আলট্রাসনোগ্রাম করতে গিয়ে লিভারে চর্বি জমেছে জানতে পারলে আতঙ্কিত কিংবা উদাসীন না হয়ে বরং সচেতন হোন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নিন।


*অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব: বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন